মিথ্যা মামলা দায়ের হলে আপনার করণীয়

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষে মানুষে, গোত্রে গোত্রে শত্রুতা চলে আসছেকাজীর কাছে  মিথ্যা নালিশ দিয়ে আগেও নিরীহ মানুষদেরকে হয়রানী করা হতবর্তমানে কথায় কথায় মিথ্যা মামলা দিয়ে অযথা মানুষকে হয়রানী করা হয়বর্তমানে মামলা হলো এমন একটি অস্ত্র যা দিয়ে প্রতিপক্ষ কে সহজেই কাবু করা যায়বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেতো কথায় নেইতাছাড়া বর্তমানে আরেক টি বিষয় উদ্বেগজনক ভাবে বেড়ে গেছেসেটা হল স্ত্রী কর্তৃক মিথ্যা মামলা দিয়ে স্বামীকে শায়েস্তা করাযৌতুক নিরোধ আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এক্ষেত্রে মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে
আদালতের মৌলিক কাজ হচ্ছে অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে এসে শাস্তি বিধান করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আইনের আশ্রয় নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সুবিচার পাবে এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু মাঝে মাঝে দেখা যায় প্রতিপক্ষকে সামাজিকভাবে হেয় করতে বা হয়রানি করতে মিথ্যা মামলা রুজু করা হয়।

যাইহোক, ধরুন কেউ আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করলোহতে পারে সে আপনার স্ত্রী, প্রতিবেশি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা দুর্নীতিবাজ পুলিশআপনি মামলার খবর শুনে যতটা হতবাক, তার চেয়েও বেশি দুশ্চিন্তায় পড়লেন, কীভাবে মিথ্যা মামলার অভিযোগ থেকে রেহাই পাবেন। আইনি লড়াই চালিয়ে সহজেই আকস্মিক এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারেন আপনি।

অনেকেই মনে করেন মিথ্যা মামলা দিয়েছে এটাতে কিছুই হবেনাধারণাটা মস্ত বড় ভুলকারণ আপনি চুপ করে বসে থাকলে আপনার প্রতিপক্ষ মিথ্যা স্বাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে মামলার রায় তার পক্ষে নিয়ে যেতে পারেতাই মিথ্যা মামলা হলে গুরুত্বহীন মনে করে চুপ করে বসে থাকা যাবেনাআপনি অপরাধী, না নিরপরাধ, সেটি মামলায় অভিযুক্ত হলেই নিশ্চিত করে বলা যাবে না। আইনের চোখে আপনার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আপনি নিরপরাধ। ধরুন, আপনার বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা হলো। আপনি দোষী বা নির্দোষ, সেটি পরে প্রমাণিত হবে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে আপনি যেন এ মামলা সুষ্ঠুভাবে মোকাবিলা করতে পারেন, সেই চেষ্টা করতে হবে।

থানায় মামলা হলে করণীয়ঃ
যদি আপনার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়, তাহলে এজাহারের কপিটি সংগ্রহের চেষ্টা করুন। আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করুন। মামলার এজাহারে দেখতে হবে, অভিযোগগুলো জামিনযোগ্য বা অযোগ্য কি না। যদি এমন হয় যে আপনি জানতে পারলেন না, আপনার বিরুদ্ধে থানায় এজাহার হয়েছে। পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেপ্তার করল। আপনাকে থানায় নিয়ে গেল। গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে আদালতে প্রেরণ করা হবে। তখন আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে হবে। যদি রিমান্ড চায়পুলিশ, তাহলে আপনার আইনজীবীর উচিত হবে রিমান্ড বাতিলের জন্য আবেদন করা। যদি জামিন দেন আদালত, তাহলে একজন পরিচিত জামিনদারের জিম্মায় আপনার জামিননামা সম্পাদন করতে হবে। যদি জামিন না হয়, তাহলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতে আবেদন করতে হবে। 

জামিন কখন এবং কোথায় চাইবেনঃ

অভিযোগ তেমন গুরুতর না হলে এবং জামিনযোগ্য হলে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে পারেন। অনেক সময় অভিযোগ জামিন-অযোগ্য হলে অনেককে হাইকোর্ট বিভাগে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে আগাম জামিন চাইতে দেখা যায়। হাইকোর্ট বিভাগ আগাম জামিন সাধারণত নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। এ মেয়াদের মধ্যেই নিম্ন আদালতে গিয়ে জামিননামা সম্পাদনের জন্য আবেদন করতে হবে। আদালতে প্রতি তারিখে হাজিরা দেওয়া বাধ্যতামূলক। কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া অনুপস্থিত থাকলে আপনার জামিন বাতিল করে দিতে পারেন আদালত। জামিন সাধারণত পুলিশ প্রতিবেদন হওয়ার আগেই চাইতে হয়। তবে পুলিশঅভিযোগপত্র দাখিল করার আগে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণদিয়ে আপনার বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অভিযোগটি দায়ের করা হয়েছে, তা প্রমাণের চেষ্টা করুন। তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটিরসত্যতা না পেলে আপনাকে নির্দোষ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবেন।

চার্জশিট দাখিলের পর কি হবেঃ
চার্জশিট বা অভিযোগপত্র হয়ে গেলে আপনার মামলাটি বিচারিক আদালতে বদলি হবে। অভিযোগ গঠনের দিন আপনাকে হাজির হয়ে নতুন করে পূর্বশর্তে জামিন চাইতে হবে এবং জামিননামা সম্পাদন করতে হবে। তখন আপনি মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে পারেন। অব্যাহতির আবেদন নাকচ হলে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন।


আদালতে মামলা হলে করণীয়ঃ

যদি থানায় মামলা না হয়ে আদালতে মামলা (সিআর মামলা) হয়, তাহলে আদালত সমন দিতে পারেন কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিন চাইতে পারেন। মনে রাখতে হবে, সিআর মামলায় অভিযুক্ত সব আসামি হাজির হলেই বিচারের জন্য মামলাটি বদলি করা হয়। আপনি কোনো কারণে হাজির না হলে আপনার জামিন বাতিল হতে পারে। পর্যায়ক্রমে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি হতে পারে। এতে হাজির না হলে আপনার মালামাল ক্রোকের আদেশ হতে পারে এবং আপনার অনুপস্থিতিতেই বিচার হতে পারে। তবে সাক্ষ্য প্রমাণে আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়ের কারীর বিরুদ্ধে আপনি প্রচলিত আইনেই মামলা দায়ের করতে পারেন।


দেওয়ানী মামলায় করণীয়ঃ
যদি আপনার বিরুদ্ধে দেওয়ানি মোকদ্দমা হয়, তাহলে জবাব দাখিলের জন্য আদালত আপনাকে সমন পাঠাবেন। নির্ধারিত তারিখে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে জবাব দাখিল করতে হবে। পরবর্তী সময়ে মোকদ্দমা ধারাবাহিকভাবে এগোবে। 

মিথ্যা মামলাকারীর বিরুদ্ধে আপনি কি পদক্ষেপ নিতে পারেন?
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০ ধারা উপধারা (১) অনুসারে কোন মামলা যদি নালিশের মাধ্যমে অথবা পুলিশের বা ম্যাজিষ্ট্রেট কাছে তথ্য প্রদান করার মাধ্যমে করা হয় এবং পরবর্তীতে যদি ম্যাজিষ্ট্রেট অভিযুক্ত বা একাধিক অভিযুক্তের কাউকে খালাস দেন এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে প্রতীয়মান হয় যে , অভিযোগগুলো মিথ্যা ও হয়রানিমূলক তাহলে কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না এই মর্মে উক্ত অভিযোগকারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে পারেন। অভিযোগকারী আদালতে অনুপস্থিত থাকলে আদালত হাজির হয়ে কারণ দর্শানোর জন্য সমন জারী করতে পারেন ।

উপধারা (২) অনুসারে, অভিযোগকারী কারণ দর্শানোর পর ম্যাজিষ্ট্রেট যদি মনে করেন আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা ও হয়রানিমূলক তাহলে সর্বোচ্চ ১০০০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারেন। এক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট হলে জরিমানার পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। জরিমানার অর্থটি মামলায় বিবাদীকে পরিশোধ করতে হবে। জরিমানা অনাদায়ে ম্যাজিষ্ট্রেট সর্বোচ্চ ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করতে পারেন।
মিথ্যা নালিশ আনয়নকারী সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ করা যায়। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয়, এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তাঁর বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করা যায়।

দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারা অনুসারে বিচারিক প্রক্রিয়ার কোন পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে বা সাক্ষ্য বিকৃত করলে ঐ ব্যক্তি সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে বা সাক্ষ্য বিকৃত করলে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

দণ্ডবিধিরি ১৯৪ ধারা অনুসারে যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য বা সাক্ষ্য বিকৃত করে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য কোন অপরাধে কাউকে দণ্ডিত করায়, সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন । এক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্য বা সাক্ষ্য বিকৃত করার ফলে যদি নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, তাহলে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকারী মৃত্যুদণ্ড বা ১৯৪ ধারায় বর্ণিত অন্যান্য দণ্ডে দণ্ডিত হবেন ।

দণ্ডবিধির ১৯৫ ধারায় উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য বা সাক্ষ্য বিকৃত করে কাউকে এমন কোন অপরাধে দণ্ডিত করায় যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সাত বছরের কারাদণ্ড, তাহলে উক্ত ব্যক্তিও সমদণ্ডে দণ্ডিত হবেন । এছাড়াও তথ্য প্রমাণ গোপন করা, অপরাধ সংগঠনের মিথ্যা সংবাদ প্রদান করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলাও করতে পারেন।








শেয়ার করুন

লেখকঃ

আমি আইন যুদ্ধে একজন লড়াকু সৈনিক। আইন সচেতন নাগরিক সমাজ গঠনে কাজ করে যাচ্ছি। পোস্টটি পড়ে যদি আপনি উপকৃত হন তাহলে নিচে একটি গঠনমূলক মন্তব্য করার জন্য অনুরোধ রইলো। আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য করে আমাদের চলার পথকে আরো বেশি বেগবান করে তুলবেন।

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
২৮ মে, ২০১৮ এ ৭:৩৪ PM

মামলার বিচার হতে হতে সব নিঃস্ব হয়ে গেলে মামলা আর পরিচালনা করবে কিভাবে?

Reply
avatar
২৩ জুন, ২০১৮ এ ৬:০৪ AM

্মিথ্যা মামলার ফলে আমার ক্ষতি হলে তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব না । এ অবস্থায় আমার করনিয় কি?

Reply
avatar
১ নভেম্বর, ২০১৮ এ ৭:০০ AM

স্যার আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক। আমাকে অযথা একটা মামলায় ৫নং আসামী দেয়া হয়েছে। আমি এখন কি করব বুঝতে পারছি না। পরামর্শ দিলে উপকৃত হতাম। 01721543001

Reply
avatar